শাপমোচন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভূমিকার গান। ভাবটা এই, মনের নানা গম্ভীর আকাঙ্খা কাহিনীতে রূপকে রূপ নেয় ছন্দে বন্ধে, সঙ্গ রচনা করে কল্পনায়, সঙ্গ রচনা করে কল্পনায়, বস্তুজগৎ থেকে ক্ষনকালের ছুটী নিয়ে কল্পজগতে লীলা।
এ শুধু অলস মায়া-- এ শুধু মেঘের খেলা,
এ শুধু মনের সাধ বাতাসে বিসর্জন,
এ শুধু আপনমনে মালা গেঁথে ছিঁড়ে ফলা,
নিমেষের হাসি কান্না গান গেয়ে সমাপন।
শ্যামল পল্লবপাতে রবিকরে সারা বেলা
আপনি ছায়া লয়ে খেলা করে ফুলগুলি,
এও সেই ছায়া-খেলা বসনর সমীরণে।
কুহকের দেশে যেন সাধ ক'রে পথ ভুলি
হেথা হোথা ঘুরি ফিরি সারাদিন আনমনে।
কারে দেব বলে কোথা যেন ফুল তুলি,
সন্ধ্যায় বনের ফুল উড়ে যায় বনে বনে।
এ খেলা খেলিবে হায়, খেলার সাথী কে আছে।
ভুলে ভুলে গান গায়-- কে শোনে কে নাই
যদি কিছু মনে পড়ে, যদি কেহ আসে কাছে।।
গৌন্ধর্ব সৌরনে সুরসনে সুরভায় গীতনায়কদের অগ্রণী। তার প্রেয়সী মধুশ্রী সূর্যপ্রদক্ষিণে। সৌরসেনের বিরহীচিত্ত ছিল উকণ্ঠিত। অনবধানে তার মৃদঙ্গের তাল গেল কেটে, নৃত্য উর্বশীর শমে পড়ল বাধা, ইন্দ্রাণীর কপালে উঠল রাঙা হয়ে।
পাছে সুর ভুলি এই ভয় হয়,
পাছে ছিন্ন তারের জয় হয়।
পাছে উৎসক্ষণ তন্দ্রালসে হয় নিমগন,
পুণ্য লগন
হেলায় খেলায় ক্ষয় হয়,
পাছে বিনা গানেই মিলনবেলা ক্ষয় হয়।
যখন তাণ্ডবে মোর ডাক পড়ে,
পাছে তার তালে মোর তাল না মেলে
সেই ঝড়ে।
যখন মরন এসে ডাকবে শেষে বরনগানে
পাছে প্রানে
মোর বাণী সব লয় হয়,
পাছে বিনা গানেই বিদায়বেলা লয় হয়।।
স্খলিতচ্ছন্দ সুরভার অভিশাপে সন্ধর্বের দেহশ্রী হল বিকৃত, অরুণেশ্বর নামে তার জন্ম হল গান্ধাররাজগৃহে।
মধশ্রী ইন্দ্রণী পাদপীঠে মাথা রেখে পড়ে রইল, "ঘটীয়ে না বিচ্ছেদ দেবি, গতি হোক একই লোকে, একই দুঃভোগে, একই অবমাননায়।''
শচী সকরুণ দৃষ্টিতে ইন্দ্রের পানে তাকালেন। ইন্দ্র বললেন, ''তথাস্তু, যাও মর্তে, সেখানে দুঃখ পাবে, দুঃখ দেবে। সেই দুঃখে ছন্দঃপাতন ক্ষয়।''
বিদায়গান
ভরা থাকস্মৃতিসুধায়
বিদায়ের পাত্রখানি,
মিলনের উৎসবে তায়
ফিরায়ে দিয়ো আনি।
বিষাদের অশ্রুজলে
নিরবের মর্মতলে
গোপনে উঠুক ফ'লে
হৃদয়ে নূতন বাণী।
যে পথে যেতে হবে
সে পথে তুমি একা,
নয়নে আঁধার রবে
ধোয়নে আলোকরেখা।
সারাদিন সঙ্গোপনে
সুধারস ঢালবে মনে
পরানের পদ্মবনে
বিরহের বীণাপানি।।
মধুশ্রী জন্ম নিল মদ্ররাজকুলে, নম নিল কমলিকা। স্বর্গ থেকে যে আত্মবিস্মৃত বিরহবেদনা এনেছপ অরুনেশ্বর, যৌবনে তার তাপ উঠল প্রবল হয়ে।
শাপমোচন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পার্ট........২
মধুশ্রী জন্ম নিল মদ্ররাককুলপ, কমলিকা। স্বর্গলোক থেকে যে আত্নবিস্মৃত সঙ্গে এনেছে অরুণেশ্বর, যৌবনে
তার তাপ উঠল প্রবল হয়ে।
জাগরনে যায় বিভাবরী,
আঁখি হতে ঘুম নিল হারি।।
যার লাগি ফিরি একা একা,
আঁখি পিপাসিত নাহি দেখা,
তার বাঁশি ওগো তারি বাঁশি
তাঁরি বাঁশি বাজে ভরি।
বীণা নাহি তবু কানে কানে
কী যে শুনি তাহা কেবা জানে।
এই হিয়া- ভরা বেদনাতে
বারি-ছলছল আঁখিপাতে
ছায়া দোলে তারি ছায়া দোলে
ছায়া দোলে দিবানিশি ধরি।।
তাপার্ত মন খুঁজে বেড়ায় অনাবৃষ্টিতে তৃষ্ণার জল, বীণা কোলে নিয়ে গান করে--
এসো এসো তৃষ্ণার জল,
ভেদ করো কঠিন বক্ষস্থল, কলকল ছলছল
এসো এসো উৎসস্রোতে গৃঢ় অন্ধকারে হতে,
এসো হে নির্মল, কলকল ছলছল।
রবিকর রহে তব প্রতিক্ষায়,
তুমি যে খেলার সাথি, সে তোমারে চায়।
তাহারি সোনার তান তোমাকে জাগাক গান,
এসো হে উজ্জ্বল, কলকল ছলছল।
হাঁকিছে অশান্ত বায়--
আয় আয় আয়, সে তোমায় খুঁজে যায়।
তাহার মৃদঙ্গরবে করতালি দিতে হবে,
এসো হে চঞ্চল, কলকল ছলছল।
অনাবৃষ্টি কোন্ মায়াবলপ
তোমার করছে বন্দী পাষাণশৃঙ্খলে,
ভেঙে নীরসের কারা এসো বন্ধহীন ধারা।
এসো হে প্রবল, কলকল ছলছল।।
কেমন করে কমলিকার ছবি এসো পড়ল গান্ধারে রাজ-অন্তঃপুরে। মনে হল, যা হারিয়েছিল এই জন্মের আড়াল, তাই যেন ফিরে ধরা দিল অপরূপ স্বপ্নরূপে।
ও আমার চাঁদের আলো, আজ ফাগুনের সন্ধ্যাকালে
ধরা দিয়েছ যে আমার পাতায় পাতায় ডালে ডালে।
যে গান তোমার সুরের ধারায় বন্যা জাগায় তারায় তারায়
মোর আঙিনায় বাজল সে সুর আমার প্রানের তালে তালে।
সরব কুঁড়ি মোর ফুটে ওঠে তোমার হাসির ইশারাতে,
স্বপ্নে- ছাওয়া দখিন হাওয়া আমার ফুলের গন্ধে মাতে।
শুভ্র, তুমি করলে বিলোল৷ আমার প্রানে রঙের হিলোল;
মর্মরিত আমার জড়ায় তোমায় হাসির জালে
ছবিখানি দিনের চিন্তা রাতের স্বপ্ন পরে আপন ভূমিকা রচনা করলে।
তুমি কী কেবলি ছবি, শুধু পটে লিখা।
ওই যে সুদূর নীহারিকা
যারা করে আছে ভিড়
আকাশে নীড়,
ওই যারা দিনরাত্রি
আলো হাতে .........
শাপমোচন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর...... পেইজ.... ০৩
আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাএী গ্রহ তারা রবি, তুমি কি তাদের মতো সত্য নও-- হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি! নয়ন সম্মুখে তুমি নাই, নয়নে মাঝখানে নিয়েছ ঠাঁই। আজি তাই শ্যামলে শ্যামল তুমি নীলিমায় নীল। আমার নিখিল তোমাতে পেয়েছে তার অন্তর মিল। নাহি জানি, কেহ নাহি জানে তবু সুর বাজে মোর গানে, কবির অন্তর তুমি কবি-- নও ছবি, নও ছবি, নও শুধু ছবি।। রাজা লিখলেন চিঠি চিত্ররূপিণীর উদ্দেশে। লিখলেন-- কখন দিলে পরায়ে স্বপন ব্যাথার মালা, বরনমালা। প্রভাতে দেখি জেগে অরুন মেঘে বিদায়বাঁশি বাজে অশ্রুগালা। গোপনে এসে গেলে, দেখি নাই আঁখি মেলে। আঁধারে দুঃখডোরে বাঁধিল মোরে, ভূষন পরালে বিরহবেদন-ঢালা।।
চিঠি পৌঁছল রাজকন্যার হাতে। অজানার আহ্বানে তার মন হল উতলা। সখীদের নিয়ে করে পড়ল সেই চিঠি। দে পড়ে দে আমায় তোরা কী কথা আজ লিখেছে সে, তার দূরের বাণীর পরশমনি লাগুক আমার প্রানে এসে। শস্যখেতের গন্ধখানি একলা ঘরে দিকে সে আনি, ক্লান্তগমন পান্থ হাওয়া লাগুক আমার মুক্তকেশে। নীল আকাশে সুরটী নিয়ে বাজাক আমার বিজন মনে, ধূসর পথের উদাস বরন মেলুক আমার বাতায়নে। সূর্য-ডোবার রাঙা বেলায় ছাড়াব প্রাণ রঙের খেলায়, আপন-মনে চোখের কোনে অশ্রু-আভাস উঠবে ভেসে।। গান্ধারের দূত এল মদ্ররাজধানীতে। বিবাহ- প্রস্তাব শুনে রাজা বললে, আমার কন্যার দুর্লভ ভাগ্য। '' সখীরা রাজকন্যাকে গিয়ে বললো-- বাজিবে সখী বাঁশি বাজিবে। হৃদয়রাজ হৃদে রাজিবে বচন রাশি রাশি কোথা যে যাবে ভাসি, অধরে লাজহাসি সাজিবে। নয়নে আঁখিজল করিয়ে ছলছল, মরমে মুরছিয়া মিলাতে চাবে হিয়া সেই চরণযুগরাজীবে।। চৈত্রপূর্ণিমার পুণ্যতিথিতে শুভলগ্ন। সেই বিবাহরাতএে দূরে একলা বসে রাজার বুকে মধ্যে রক্ত ঢেউ খলিয়ে উঠল। কেবল তার মনে হতে লাগলো, লোকান্তর কার সঙ্গে এইরকম জ্যোৎস্নারাএে সে যেন এক- দোলায় দুলেছিল। ভুলে- যাওয়ার কুহেলিকার ভিতরে থেকে পড়ছে মনে। একটা পদ তার মনে গুঞ্জনরিয়া উঠছে ভুলো না-ভুলো-না ভুলো- না''---
সেদিন দুজনে দুলেছিল বনে, ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা। সেই স্মৃতিটুকু কভু খনে খনে যেন জাগে মনে, ভুলো না। সেদিন বাতাসে ছিল তুমি জান আমারি মনের প্রলাপ জড়ানো তোমার হাসির তুলনা। যেতে যেতে পথে পূর্ণিমা রাতে চাঁদ উঠেছিল গগনে,। দেখা হয়েছিল তোমাতে আমাতে কী জানি কী মহালগনে। এখন আমার বেলা নাহি আর, বহিব একাকী বিরহের ভার-- বাঁধিব যপ রাখী পরানে তোমার সে রাখী খুলে না খুলোনা।।লহাে লহাে তুলে লহাে নীরব বীণখানি, নন্দননিকুঞ্জ হতে সুর দেহ তায় আনি ওহে সুন্দর হে সুন্দর। আধার বিছায়ে আছি রাতের আকাশে তোমারি আশ্বাসে, তারায় তারায় জাগাও তােমার আলােক-ভরা বাণী ওহে সুন্দর হে সুন্দর। পাষাণ আমার কঠিন দুখে তােমায় কেদে বলে-পরশ দিয়ে সরস করাে, ভাসাও অশ্রুজলে ওহে সুন্দর হে সুন্দর। শুক যে এই নগ্ন মরু নিত্য মরে লাজে আমার ঢিমাঝে, শ্যামল রসের আঁচল তাহার বক্ষে দেহে টানি।। বধূ পতিগৃহে যাবার সময় সখীরা সুন্দরকে প্রণাম করে বললে- রাঙিয়ে দিয়ে যাও গাে এবার যাবার আগে। আপন রাগে, গােপন রাগে, তরুণ হাসির অরুণ রাগে, অশ্রুজলের করুণ রাগে। রঙ যেন মাের মর্মে লাগে--আমার সকল কর্মে লাগে-সন্ধ্যার্দীপের আগায় লাগে-গভীর রাতের জাগায় লাগে। যাবার আগে যাও গাে আমায় জাগিয়ে দিয়ে, রক্তে তােমার চরণদালা লাগিয়ে দিয়ে। আধার নিশার বক্ষে যেমন তারা জাগে, পাষাণহার কক্ষে নিঝর-ধারা জাগে, মেঘের বুকে যেমন মেঘের মন্দ জাগে, বিশ্বনাচের কেন্দ্রে যেমন ছন্দ জাগে-তেমনি আমায় দোল দিয়ে যাও যাবার পথে আগিয়ে দিয়ে কাঁদন বাঁদন ভাগিয়ে দিয়ে।। ... রাজবধূ এল পতিগৃহে। দীপ জ্বলে না,ঘর থাকে অন্ধকার, সেই ঘরে প্রতি রাত্রে স্বামীর কাছে বধূ সমাগম। কমলিকা বলে, “প্রভু, তোমাকে দেখবার জেন্য আমার দিন, আমার রাত্রি উৎসুক। আমাকে দেখা দাও । | এসো আমার ঘরে বাহির হয়ে এসে তুমি যে আছো অন্তরে। সূখঃখের দোলে এসো প্রাণের হিল্লোলে এসাে, স্বপনদুয়ার খুলে এসো অরুন-আলোকে কল-কার সূলে এসো অরুণ-আলােকে মুগ্ধ এ চোখে। এবার ফুলের প্রফুল্লরূপ বুকের 'পরে।। রাজা বলে, "আমার গান তুমি আমাকে দেখে। আগে দেখে নাও অন্তরে, বাইরে দেখবাযর দিন। আসবে তার পরে। নইলে ভুল হবে, ছন্দ যাবে ভেঙে। কোথা বাইরে দূরে যায় যে উড়ে হায় রে হায় তোমার চপল আঁখি বনের পাখি পালায়। ওগো হৃদয়ে যাবে মোহন রবে বাজবে বাঁশি তখন আপনি সেধে ফিরবে কেঁদে, পরবে ফাঁসি-- তখন ঘুচবে ত্বরা, ঘুরিয়া মরা হেথা হোথায়। চেয়ে দেখিস নারে হৃদয়াদ্বরে কে আসে যায়-- তোরা শুনিস কানে বারতা আনে দখিন বায়।
আজি ফুলের বাসে সুখের হাসে আকুল গানে চির- বসন্ত যে তোমারি খোঁজে এসেছে প্রানে, তারে বাহিরে খুঁজি ফিরছি বুঝি পাগলপ্রায়-- আহা আজি সে আঁখি বনের পাখি বনে পালায়।। অন্ধকারে বীণা বাজে। অন্ধকারে গান্ধর্বী কলার নৃত্যে বধুকে।।