খেজুরের রস
খেজুরের রস বা খেজুর রস হল খেজুর গাছ থেকে সংগ্রহকৃত রস। সাধারণত মাটির হাড়ি দিয়ে খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। তবে বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে মাটির বদলে প্লাস্টিক দিয়ে সংগ্রহ করা হয়। খেজুরের রস দিয়ে ফিরনি, পায়েস এবং খেজুরের রস থেকে উৎপন্ন গুড় দিয়ে ভাঁপা পিঠা এবং গাঢ় রস দিয়ে তৈরি করা হয় মুড়ি, চিড়া, খই ও চিতই পিঠাসহ হরেক রকম পিঠাপুলি। খেজুরের রস পান করলে শরীরের দুর্বলতা দূর হয়। এতে উচ্চ প্রাকৃতিক চিনি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান রয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে খেজুরের রস পান করলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে হয়।
খেজুরের রস সংগ্রহ
খেজুর শুষ্ক ও মরু অঞ্চলের উদ্ভিদ হওয়ায় গঙ্গার নিম্ন অববাহিকার খেজুর গাছে যথেষ্ট শাঁসযুক্ত অর্থাৎ উৎকৃষ্ট খেজুর হয় না। তাই এটি খাদ্য হিসেবে খুব একটা ব্যবহার হয় না। তবে এই গাছের রস আকর্ষণীয়।
গাছের বয়স
সাধারণত চার বছর বয়সের পর থেকে খেজুর গাছের রস আহরণ শুরু হয় যখন গাছে ১২-১৫টি পাতা থাকে। খেজুরের চিনি, গুণমান ইত্যাদির পরিমাণ মাটি, জলবায়ু এবং খেজুরের প্রকারের উপর নির্ভর করে। পুরুষ গাছ স্ত্রী গাছের চেয়ে বেশি রস দেয় এবং রসও তুলনায় বেশি মিষ্টি হয়।
রস সংগ্রহের অনুকূল সময় ও আবহাওয়া
আশ্বিন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু করে বৈশাখ মাসের প্রথম সপ্তাহ (অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি) পর্যন্ত রস সংগ্রহ করা হয়। ঠান্ডা আবহাওয়া, মেঘলা আকাশ ও কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল পর্যাপ্ত রসের জন্য উপযোগী। এই সময়ে প্রাপ্ত রসের স্বাদও ভালো হয়। পৌষ-মাঘ মাসে (ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি) সবচেয়ে বেশি রস পাওয়া যায়। তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে রসের পরিমাণ ও মান কমতে থাকে।
সংগ্রহ
খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে খেজুর গাছের মাথার অংশকে ভালো করে পরিষ্কার করা হয়। এরপর পরিষ্কার সাদা অংশ কেটে বিশেষ কায়দায় ছোট-বড় কলসিতে রস সংগ্রহ করা হয়।
শীতের মৌসুমে প্রতিদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে গাছের মাথার সাদা অংশ পরিষ্কার করে গাছে হাড়ি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। সকাল হলে সেই হাড়ি নামিয়ে আনা হয়। রস দিয়ে পাটালি ও লালি গুড় তৈরি করে সাধারণত বিক্রি করে দেওয়া হয়। তবে গাছিরা যে হাড়ি ঝুলিয়ে রাখে তাতে অনেক সময় কীট পতঙ্গ প্রবেশ করে অস্বাস্থ্যকর রসে পরিণত করতে পারে।
খেজুরের রস
খেজুর গুড় এক ধরনের গুড় যা খেজুরের রস থেকে তৈরি করা হয়। বাংলা অগ্রহায়ণ মাস থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। খেজুরের উত্তাপে রসকে ঘন ও শক্ত পাটালিগুড়ে পরিণত করা হয়। ধরন অনুযায়ী খেজুরের গুড়কে ঝোলা গুড়, দানাগুড়, পাটালি, চিটাগুড় ইত্যাদি ভাগে ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রপ্তিস্থান
বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে এবং ভারতের কিছু অঞ্চলে খেঁজুরের গুড় পাওয়া যায়। এক সময় এ খেজুরের রস থেকে চিনি তৈরি করা হতো। বৃহত্তর যশোর ও ফরিদপুর জেলা, নদীয়া জেলার কিছু অংশ, বসিরহাট ও সাতক্ষীরা মহকুমায় এবং চব্বিশ পরগনায় ব্যাপকভাবে খেজুর গাছের চাষ হতো। এখনও এসব এলাকাতেই খেজুরের গুড় বেশি উৎপাদিত হয়। ১৯৪০-এর দশকের প্রথম দিকে চবিবশ পরগনার হাওড়া, মেদিনীপুর এবং ফরিদপুর জেলাগুলিতে এ শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটে। তৎকালীন সময়ে প্রতি বছর মোট ১,০০,০০০ টন গুড় উৎপাদিত হতো। ১ বিঘা জমিতে ১০০টি গাছ লাগানো যায়। সাত বছরের মধ্যে গাছগুলি ফল ও রস সংগ্রহের উপযোগী হয় এবং ত্রিশ/চল্লিশ বছর পর্যন্ত ফলন দেয়।
খেজুরের রস আহরণ
একটি খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের পূর্বে অগ্রহায়ণের শেষের দিকে গাছের কান্ডের একেবারে উপরের অংশে পাতাসম্বলিত বাকলগুলি ধারালো দা দিয়ে চেঁছে পরিষ্কার করা হয় যাকে গাছ তোলা বলে। সাত থেকে আট দিন পরে পুনরায় পরিষ্কার করা হয়। গাছ তোলার দুই সপ্তাহের মাথায় চাঁছা অংশ কিছুটা কেটে নলি (বাঁশের নল) ও খিল লাগিয়ে এবং সম্মুখভাগে হাঁড়ি ঝুলিয়ে দিয়ে রস সংগ্রহ করা হয়।
রস আহরণের সময়কালের উপর ভিত্তি করে খেজুরের রসকে জিড়ান, দোকাট এবং ঝরা এই তিনভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। প্রথম রাতের গুণে ও মানে সর্বোৎকৃষ্ট এবং পরিমাণেও সর্বোচ্চ রসকে বলা হয় জিড়ান । পরদিন বিকালে গাছের চোখ বা কাটা অংশটুকু দা এর সাহায্যে চেছে পরিষ্কার করা হয় এবং দ্বিতীয় রাত্রের নির্গত রসকে বলা হয় দোকাট। দোকাটের রস জিড়ানের মতো সুস্বাদু কিংবা মিষ্টি নয় এবং পরিমাণেও হয় কম। তৃতীয় রাতে প্রাপ্ত রসকে ঝরা রস বলা হয়। ঝরা রস দোকাটের চেয়েও পরিমাণে কম এবং কম মিষ্টি। অনেক ক্ষেত্রে ঝরা রস টক স্বাদযুক্ত হয়। পরবর্তী তিনদিন গাছকে অবসর দেওয়া হয়। এরপর আবার নতুন করে চাঁছা (কাটা) ও রস সংগ্রহ করা হয়।
খেজুরের রস আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে। আবহাওয়া শীতার্ত এবং পরিচ্ছন্ন হলে রস পরিষ্কার ও মিষ্টি হয়। মেঘলা গুমোট রাতে খেজুরের রসে টকভাব আসে। নভেম্বরের প্রথম দিকে রস আহরণ শুরু হলেও ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি মাসে সর্বাধিক পরিমাণে পাওয়া যায়।
গুড় তৈরি
সাধারণ অবস্থায় খেজুরের রস দীর্ঘসময় রেখে দিলে গাঁজন প্রক্রিয়ার ফলে তা নষ্ট হয়ে যায়। এই গাঁজনের মাধ্যমে খেঁজুরের রস থেকে তাড়ি বা দেশীয় মদ প্রস্তুত করা হয়। একটি বড় পাত্র বা তাফালে গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস ছেকে জ্বাল দেয়া হয়। এক পর্যায়ে রস ঘন হয়ে ঝোলা গুড়ে পরিণত হয়। পাটালি গুড় তৈরি করার জন্যে নির্দিষ্ট পরিমাণে ঘণ করার পরে তা ছাঁচে ঢেলে দেয়া হয়। গুড়কে খুব বেশি জ্বাল দিলে চিংড়ি তৈরী হয় যা একদা গ্রাম বাংলা চকোলেট, দেলবাহার ইত্যাদি নামে বিক্রি হতো।
বাংলাদেশের প্রায় সকল অঞ্চলে খেঁজুরের গুড় স্থানীয়ভাবে তৈরি হলেও নির্দিষ্ট কিছু স্থানের গুড় নিজস্ব স্বকীয়তা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। যেমন যশোরের খাজুরার পাটালিগুড়, মানিকগঞ্জের হাজারী গুড় ইত্যাদি।
খেজুরের রস কোথায় পাওয়া যাই
ঢাকাবাসীর জন্য খেজুরের রস পাওয়ার একমাত্র নিশ্চিত স্থান হল তিনশ ফিট রোড খ্যাত পূর্বাচল এলাকা। ... প্রায় প্রতিদিনই এই বাজারে বসেন এই রস বিক্রেতা।
খেজুরে কি ভিটামিন আছে
শরীরের জন্য অত্যাবশ্যক ভিটামিন (বি১, বি২, বি৩ এবং বি৫) ছাড়াও ভিটামিন সির ভালো উৎস এটি। আর এটি দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করার পাশাপাশি রাতকানা রোগ প্রতিরোধেও কার্যকরী। ৫. খেজুরে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম থাকায় এটি হাড়কে মজবুত করে।
খজুর বেশি খেলে কি হয়
খেজুর খুব স্বাস্থ্যকর খাবার। শুকনো এই ফলে প্রচুর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকে। এছাড়া খেজুরে আয়রন, পটাশিয়াম, সেলেনিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম,কপার, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ভিটামিন সি, ফাইবার, প্রোটিন থাকে প্রচুর। ... দুধ ও খেজুরের এই কম্বিনেশন খেলে অ্যানিমিয়া অর্থাৎ রক্তস্বল্পতা রোগ সেরে উঠে।
খেজুর খাওয়ার উপকারিতা ও নিয়ম
এতে থাকা নানা উপাদান হৃৎপিন্ডের উপকার করে ও হৃৎস্পন্দন ঠিক রাখতে সাহায্য করে। তাই হার্টকে সুস্থ রাখতে খেতে পারেন যেকোনো প্রজাতির খেজুর। ... রাতে ভিজিয়ে রেখে সকালে খেজুর খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। তাই নিয়ম করে প্রতিদিন সকালে এটি খাওয়া ভালো যাদের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা আছে।
কাঁচা খজুর খাওয়ার উপকারিতা
খেজুরের পুষ্টি উপাদান সম্পর্কে বলা হয় চারটি বা ৩০ গ্রাম পরিমাণ খেজুরে আছে ৯০ ক্যালোরি, এক গ্রাম প্রোটিন, ১৩ মিলি গ্রাম ক্যালসিয়াম, ২.৮ গ্রাম ফাইবার এবং আরও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান। খেজুর শক্তির একটি ভালো উৎস। তাই খেজুর খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শরীরের ক্লান্তিভাব দূর হয়। ... আয়রনে ভরপুর খেজুর খেতে পারেন প্রতিদিন।
শুকনা খেজুর খাওয়ার উপকারিতা
পুষ্টিগুণে ভরপুর খেজুরে রয়েছে ভিটামিন, আঁশ, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও জিঙ্ক। খেজুর একজন সুস্থ মানুষের শরীরে আয়রনের চাহিদার প্রায় ১১ ভাগই পূরণ করে। তাই প্রতিদিন খেতে পারেন খেজুর। পুষ্টিবিদদের মতে, শরীরের প্রয়োজনীয় আয়রনের অনেকটাই খেজুর থেকে আসে।
খেজুর সংক্ষন পদ্ধতি
অতপর ফ্রিজের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রেখে দৈনিক খেতে থাকুন এবং স্বাদও ঠিক থাকবে । যে সকল খেজুর আধা শুকনো অবস্থায় থাকে তাহা সংরক্ষণ পদ্ধতি। আপনার রান্নাঘরের কাউন্টারে খেজুরগুলি রাখুন। আপনি যদি কোন তাকে বা সেলফে রাখেন তবে তা সরাসরি সূর্যের আলো থেকে দূরে আছে কিনা তা নিশ্চিত করুন।
খেজুরের গুড় সংরক্ষন পদ্ধতি
> গুড় রোদে দেয়া সম্ভব না হলে কিছুদিন পরপর আগুনে জাল দিয়ে সংরক্ষণ করা যায়। সেক্ষেত্রে গুড় চুলায় জ্বাল দিয়ে বুদবুদ না আসা পর্যন্ত গরম করতে হবে। গুড় ঠাণ্ডা হয়ে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এলে প্লাস্টিক বক্সে করে ফ্রিজে রেখে দিন।