আইন কি
মানুষকে সুষ্ঠু, স্বাধীন এবং সুশৃংখলভাবে পরিচালনার জন্য যে নিয়ম-কানুন তৈরি করা হয় তাকে আইন বলে। আইনের ইংরেজি প্রতিশব্দ Law যা Lag নামক শব্দ থেকে উদ্ভূত। Lag এর আভিধানিক অর্থ স্থির, অপরিবর্তনীয় এবং যা সর্বত্র সমানভাবে প্রযোজ্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আইন হলো সার্বভৌম শক্তি কর্তৃক বলবৎযোগ্য বিধান, যা সকলের জন্য অবশ্য পালনীয়।
আইন হলো নিয়মের এক পদ্ধতি যাকে নাগরিক বাধ্যতা, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজের ভিত্তি নির্মাণ করতে ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কার্জকরী করতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া আইন বলতে সামাজিকভাবে স্বীকৃত লিখিত ও অলিখিত বিধিবিধান ও রীতিনীতিকে বোঝায়। ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিষ্টটল লিখেছিলেন, "আইনের শাসন যেকোন ব্যক্তি শাসনের চেয়ে ভাল।" সামাজিক জীবনে যে রীতিনীতি বা বিধিবিধান মানুষ মেনে চলে তা হলো সামাজিক আইন। অপরদিকে রাষ্ট্রীয় আইন হলো রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বিভিন্ন জাতীয় নীতিমালার প্রেক্ষিতে সমাজে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যা প্রতিরোধে সার্বজনীনভাবে সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন নির্দেশ।
সংজ্ঞা
মূলধারার সংজ্ঞা
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আইনের অসংখ্য সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। মেরিয়াম-ওয়েস্টার হতে তৃতীয় নতুন আন্তর্জাতিক অভিধান আইনটিকে এইভাবে সংজ্ঞায়িত করেন: আইন একটি সম্প্রদায়ের বাধ্যতামূলক রীতি; একটি নিয়ম বা আচরণের পদ্ধতি বা পদক্ষেপ যা একটি সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ দ্বারা বাধ্যতামূলক হিসাবে নির্ধারিত বা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত ; নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত, স্বীকৃত বা প্রয়োগের দ্বারা অনুমোদনের (বাধ্যতামূলক, ডিক্রি, রিসক্রিপ্ট, আদেশ, অধ্যাদেশ, আইন, সমাধান, বিধি, বিচারিক সিদ্ধান্ত বা ব্যবহার হিসাবে) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
১৯৭৩ সালে স্ক্রিবনার দ্বারা প্রকাশিত আইডিয়াস অফ হিস্ট্রি অফ আইডিয়াস আইন অনুসারে সংজ্ঞাটিকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিল: "একটি আইনি ব্যবস্থা হলো মানব আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার সবচেয়ে সুস্পষ্ট, প্রাতিষ্ঠানিক এবং জটিল পদ্ধতি, একই সাথে এটি কেবল একটি অংশে ভূমিকা পালন করে, কম প্রাতিষ্ঠানিক ধরনের সামাজিক ও নৈতিক বিধিগুলির জন্য আচরণকে প্রভাবিত করে৷
প্রশাসনিক আইন
প্রশাসনিক আইন বা Administrative law হলো আইনের একটি অঙ্গ যা সরকারের প্রশাশনিক সংস্থাগুলোর কার্যক্রম পরিচালনা করে। নিয়ম-কানুন তৈরি করা, বিচার কার্য পরিচালনা করা এবং তা প্রয়োগ করাই এই বিভাগের প্রধান কাজ। পাবলিক আইনের একটি শাখা হিসেবে প্রশাসনিক আইন বিবেচিত হয়।
প্রশাসনিক আইনে সাধারণত পুলিশ আইন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, উৎপাদন করারোপণ, সম্প্রচার, অভিবাসন ও পরিবহণের ক্ষেত্রে নানাবিধ নিয়ম তৈরি ও তা প্রয়োগের জন্য প্রশাসনিক আইনের আওতায় সরকারের বিভিন্ন ট্রাইবুনাল, বোর্ড বা কমিশন সব সরকারের প্রশাসনিক ইউনিটগুলো কাজ করে থাকে।
বিংশ শতাব্দীতে প্রশাসনিক আইন ব্যাপক ভাবে প্রসার লাভ করে এর পেছনে মূল কারণ ছিলো দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন সংস্থা গঠন হতে থাকা এবং এইগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা আইনসংস্থার সৃষ্টি।
সিভিল আইন যেসব দেশে বিদ্যমান সে সকল দেশে প্রশাসনিক আদালত দ্বারা সিদ্ধান্তগুলো পর্যালোচিত হয়।
আন্তর্জাতিক আইনের উৎস
আন্তর্জাতিক আইনের উৎসগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়:
- আনুষ্ঠানিক উৎস;
- বস্তুগত উৎস।
একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিতে সার্বভৌম রাষ্ট্রের সাধারণ সম্মতি সৃষ্টি হয়। এ সাধারণ সম্মতি আন্তর্জাতিক আইনের মূল ভিত্তি। রাষ্ট্রসমূহের এ সাধারণ সম্মতি আন্তর্জাতিক আইনকে বৈধতা দান করে। সুতরাং আন্তর্জাতিক আইন পালনের মূলসূত্র হিসেবে সাধারণ সম্মতিকে ধরে নিয়ে "জনগণের ইচ্ছা" যা রাষ্ট্রসমূহের সমন্বিত ইচ্ছা দ্বরা প্রতিফলিত হচ্ছে, তাকে আন্তর্জাতিক আইনের আনুষ্ঠানিক উৎস বলা হয়।
আবার যেসব বিষয় বা বস্তু আন্তর্জাতিক আইনের উপস্থিতির সাক্ষ্য দেয় অর্থাৎ যে প্রকৃত উৎস থেকে আইন তার শক্তি আহরণ করে, তাকে বস্তুগত উৎস বলে। আন্তর্জাতিক চুক্তি, প্রথা, আন্তর্জাতিক আদালতের সিদ্ধান্ত বা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের গৃহীত প্রস্তাবাবলী বস্তুগত উৎসের অন্তর্গত। আন্তর্জাতিক আইন মূলত প্রথাভিত্তিক আইনের একটি অন্যতম উৎস হিসেবে স্বীকৃত। প্রথাই আন্তর্জাতিক আইনের প্রাথমিক উৎস এবং অনেকাংশে প্রথাসমূহই ক্রমান্বয়ে চুক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হিসেবে ন্যায়পরায়ণতাকে বিবেচনায় আনা হয়।
আন্তর্জাতিক আদালতের সংবিধি ৩৮ (১)
আন্তর্জাতিক আইনের উৎস নির্ণয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের সংবিধি ৩৮ (১) ধারা যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। এ ধারা অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আদালত যে আইন প্রয়োগ করবে তা হল:
- বিভিন্ন বিধি-বিধান সৃষ্টিকারী আন্তর্জাতিক কনভেনশন বা চুক্তি যা বিরোধপক্ষসমূহ কর্তৃক স্বীকৃত;
- আন্তর্জাতিক প্রথা যা আইন হিসেবে সাধারণভাবে স্বীকৃত;
- আইনের সাধারণ নীতিমালা যা সভ্য জাতিসমূহ কর্তৃক স্বীকৃত;
- বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত; এবং
- বিভিন্ন দেশের খ্যাতিমান পণ্ডিত ব্যক্তিদের মতবাদ যা আইনের বিধান নির্ণয়ে সহায়ক ভূমিকা পালনে সক্ষম।
আইনসভা
আইনসভা দ্বারা প্রণীত আইনগুলি প্রাথমিক আইন হিসাবে পরিচিত। আইনসভা প্রশাসনিক ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণ ও পরিচালনা করে এবং সাধারণত বাজেট বা বাজেট সংক্রান্ত প্রক্রিয়া সংশোধন করার একচেটিয়া কর্তৃত্ব থাকে।
কোন আইনসভার সদস্যদের আইন-প্রণেতা বলা হয়। গণতান্ত্রিক দেশে আইন-প্রণেতারা সাধারণত জনপ্রিয় ভোটে নির্বাচিত হন, যদিও নির্বাহী কর্তৃক পরোক্ষ নির্বাচন এবং মনোনয়ন দ্বারাও এটি গঠিত হয়, বিশেষত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভাগুলির উচ্চকক্ষে এটি ঘটে থাকে।
আইনের শাসন
আইনের শাসন রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিবিশেষ, যেখানে সরকারের সকল ক্রিয়াকর্ম আইনের অধীনে পরিচালিত হয় এবং যেখানে আইনের স্থান সবকিছুর ঊর্ধ্বে। ব্যবহারিক ভাষায় আইনের শাসনের অর্থ এই যে, রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার সর্বদা আইন অনুযায়ী কাজ করবে, যার ফলে রাষ্ট্রের যেকোন নাগরিকের কোনো অধিকার লঙ্ঘিত হলে সে তার প্রতিকার পাবে। মোট কথা, আইনের শাসন তখনই বিদ্যমান থাকে, যখন সরকারি ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অনুশীলন সাধারণ আদালতের পর্যালোচনাধীন থাকে, যে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার অধিকার সকল নাগরিকের সমান।
দেশভেদে আইনের শাসনের বিভিন্ন প্রকারভেদ লক্ষ্য করা যায়। ইংল্যান্ডে যেসব সাধারণ নীতি দ্বারা আইনের শাসন নিশ্চিত হয়েছে তার অধিকাংশই সেখানকার নাগরিকদের আদালতে উত্থাপিত বিভিন্ন মামলার বিচার বিভাগীয় রায়ের ফসল। ওইসব রায়ে নাগরিকদের ব্যক্তিগত অধিকার নির্ধারিত হয়েছে। এ ছাড়া ম্যাগনা কার্টা (১২১৫), দ্য পিটিশন অব রাইটস (১৬২৮) এবং বিল অব রাইটস (১৬৮৯)-এ ইংরেজদের স্বাভাবিক অধিকারসমূহ ঘোষিত হয়েছে, যা ওই দেশের আইনের শাসন নিশ্চিত করে। ইংরেজ জাতির ঐতিহ্য, রীতিনীতি, ব্যবহারবিধি এবং তাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বিকাশের দীর্ঘ ইতিহাসের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত অধিকার সম্পর্কে ইংরেজদের সচেতনতা গড়ে উঠেছে। সেগুলো পরবর্তীকালে সৃষ্ট অনেক নতুন রাষ্ট্রের লিখিত সাংবিধানিক দলিলের মতোই পবিত্র ও অলঙ্ঘনীয়। অধিকাংশ নতুন রাষ্ট্রের সংবিধানে ইংরেজদের ওইসব অলিখিত নীতিমালা সন্নিবেশিত হয়েছে।
ঐতিহাসিক পটভূমি ভারতে ব্রিটিশ শাসনামলে ফৌজদারি দন্ডবিধির ১৪৪ ধারা এবং প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন অ্যাক্টের কারণে আইনের শাসন গুরুতরভাবে বাধাগ্রস্ত ছিল। পাকিস্তানে গৃহীত অন্তবর্তীকালীন শাসনতন্ত্রে বিল অব রাইটস-এর বৈশিষ্ট্যময় কোনো বিধিবিধান ছিল না। ব্রিটিশ শাসনাধীনে আইনের শাসনের দুঃখজনক অভিজ্ঞতা, গণতন্ত্রের অনুশীলনে ইংরেজ ঐতিহ্যের অনুপস্থিতি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষার প্রয়োজনে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে বিল অব রাইটস-এর নীতিমালা সন্নিবেশের পক্ষে ব্যাপক মতামত পরিলক্ষিত হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় গণপরিষদে বেশকিছু সাধারণ অধিকারের নীতি গৃহীত হয়, যেমন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার; সুযোগ ও মর্যাদার সমতা; চিন্তা, মতপ্রকাশ, সংগঠন, আন্দোলন করার স্বাধীনতা; বিশ্বাস ও ধর্ম পালনের স্বাধীনতা; এবং নাগরিক স্বাধীনতা যথা, জীবন যাপনের অধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা, সম্পদের মালিকানা রক্ষার স্বাধীনতা ইত্যাদি। অধিকাংশ সংবিধানে যেমনটি দেখা যায়, এসব অধিকার সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও নিশ্চয়তাসহ পাকিস্তানের গণপরিষদেও নিশ্চিত করা হয়।
নাগরিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এ মর্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান গৃহীত হয় যে, গ্রেফতারের কারণ যথাশীঘ্র সম্ভব জানানো ব্যতিরেকে কোনো ব্যক্তিকে আটক রাখা যাবে না এবং তার আত্মপক্ষ সমর্থন ও আইনি পরামর্শের অধিকার নাকচ করা চলবে না। তাছাড়া, আটক ব্যক্তিকে তার আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করতে হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়া ওই ব্যক্তির আটকের মেয়াদ বাড়ানো যাবে না। ১৯৬২ সালের সংবিধানেও অনুরূপ বিধান গৃহীত হয়। সে সময় প্রতীয়মান হয় যে, পাকিস্তানে একটি সীমাবদ্ধ শাসন প্রণালীতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি, ব্রিটিশ আমলে আরোপিত অনেক বিধিনিষেধ পাকিস্তানেও অব্যাহত ছিল যা দ্বারা নাগরিক অধিকার খর্বিত হচ্ছিল। ফৌজদারি দন্ডবিধির ১৪৪ ধারার অধীনে, নির্দিষ্ট স্থানে সভা-সমাবেশ ও মিছিলে নিষেধাজ্ঞা, সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ সৃষ্টিতে প্ররোচনা দানের অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং সংবাদপত্রের ওপর বিধিনিষেধ অব্যাহত ছিল। তবে নাগরিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুতর বিধিনিষেধগুলো আরোপিত হয় সিকিউরিটি অব পাকিস্তান অ্যাক্ট-এর আওতায়, যাতে যেকোনো নাগরিককে নিবৃত্তিমূলক আটকাদেশের বিধান রয়েছে।
প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন অ্যাক্ট বা নিবৃত্তিমূলক আটকাদেশ আইনের অধীনে সরকার যেকোনো নাগরিককে পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার পক্ষে হানিকর হতে পারে এমন যেকোনো সরকার-বিরোধী কর্মকান্ডের অভিযোগে আটক করার ক্ষমতা লাভ করে। সভা-সমাবেশে বাধা দানের উদ্দেশ্যেও সরকার যেকোনো ব্যক্তিকে আটক করার ক্ষমতা পায়। ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল, সংবাদপত্রসহ সকল কিছুই সিকিউরিটি অব পাকিস্তান অ্যাক্টের আওতায় পড়ত এবং সরকার এ আইনের বলে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে যেকোনো সংগঠনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা ভোগ করত। এগুলো ছিল জনগণের মৌলিক অধিকারের গুরুতর সংকোচন। কিন্তু সদ্য স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের সম্ভাব্য অভ্যন্তরীণ ও বহির্দেশীয় হুমকির আশঙ্কায় এসব বিধান দেশের বিধিবদ্ধ আইনে সংরক্ষিত ছিল। তাই দেখা যায়, পাকিস্তান আমলে সংবিধানে ঘোষিত অধিকারসমূহ বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছিল শুধু তাই নয়, সেখানে নিবৃত্তিমূলক আটকের বিধানও ছিল, যার অন্তর্নিহিত অভিপ্রায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না বলেই মনে হয়।
বাংলাদেশ আমল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধানে বিল অব রাইটস-এর অনেক বিষয় অনুরূপ ও সাধারণ বৈশিষ্ট্যসহ গৃহীত হয়। বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারসমূহ পাকিস্তানের সংবিধান (১৯৫৬ ও ১৯৬২) এবং ভারতের সংবিধান থেকে ব্যাপকভাবে গৃহীত। তবে এখানেও সেগুলো কিছু পরিচিত বৈশিষ্ট্য দ্বারা সীমাবদ্ধ।
১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রদত্ত অধিকারসমূহ ছিল মর্যাদা, সুযোগ লাভ ও ধর্মপালনের অধিকারের সমতা; আইনের দৃষ্টিতে প্রত্যেক নাগরিকের সমতা; ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও বাঁচার অধিকার সুরক্ষা; অযৌক্তিক গ্রেফতার বা আটক, বিচার বা দন্ড থেকে সুরক্ষা; সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা। বাংলাদেশে বহু জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব তূলনামূলকভাবে কম, একটি নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের সংখ্যাধিক্য ব্যাপক হওয়ায় এদেশ অপেক্ষাকৃত সমজাতীয় বলে বিবেচিত। সে কারণে পাকিস্তান ও ভারতের মতো এদেশের সংবিধানে জাতীয় সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদা বিধান রাখা হয় নি। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে ইংরেজদের সে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যাতে আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান, সকল শ্রেণি একটি অভিন্ন আইনের অধীন, যে আইন কার্যকর হবে সাধারণ আদালতের মাধ্যমে; জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে সে আইনের প্রয়োগ হবে সমান। এ মতবাদের আইনগত দিকটি আইনের শাসন দ্বারা পরিচালিত যেকোনো দেশেই একটি মৌলিক বিষয়। সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদেও এটা সুস্পষ্ট করা হয়েছে; সেখানে সরকারি চাকুরিতে সকল নাগরিকের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে। ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের ভিত্তিতে কোনো নাগরিক কোনোরূপ বৈষম্যের শিকার হবে না। এটা সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয় প্রয়াসের ইঙ্গিতবহ। কিছু সীমাবদ্ধতাসহ সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে সংবিধানের ৪২(১) অনুচ্ছেদে।
সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সীমিত শাসন ও আইনের শাসনের ধারণাটি দৃঢ়তর হয়েছে, যেখানে একজন ব্যক্তির বাঁচার অধিকার ও স্বাধীনতা তথা মৌলিক অধিকারসমূহের মর্মবস্ত্ত নিশ্চিত করা হয়েছে। অর্থাৎ নির্বাহি বিভাগের কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতার অনুপস্থিতি ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারের অঙ্গীকার রয়েছে এখানে। শর্তারোপ করা হয়েছে যে, দেশের সাধারণ আদালতে সাধারণ আইনি প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত কোনো আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ব্যতিরেকে কোনো ব্যক্তিকে দন্ড দান করা চলবে না, বা আইনের দ্বারা দৈহিক বা বৈষয়িকভাবে কোনো ব্যক্তির ভোগান্তি সৃষ্টি করা যাবে না। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা রক্ষার্থে একজন নাগরিক আইনের সুরক্ষার অধিকার রাখে।
গ্রেফতারের আইনসঙ্গত ভিত্তি ছাড়া কোনো নাগরিককে আটক রাখা যাবে না, তার আইনি পরামর্শ লাভের অধিকার বা উকিল দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার নাকচ করা যাবে না, তাকে গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে এবং আদালতের আদেশ ছাড়া তাকে অধিক সময় আটক রাখা যাবে না।
এসব অধিকার কার্যকর করার ক্ষমতা উচ্চতর আদালতগুলোকে দেয়া হয়েছে। আদালতসমূহ তাদের সংশ্লিষ্ট আইনগত এখতিয়ারের মধ্যে নির্দিষ্ট রিট জারি করতে পারে, যথা হেবিয়াস কর্পাস, ম্যান্ডামাস, প্রোহিবিশন, কু ওয়ারান্টো এবং সারটিওরারি। তবে, অন্তবর্তীকালীন সময়ে এবং সংবিধান অনুমোদনের পূর্বে গৃহীত প্রথম তফশিলে উল্লিখিত ৪৭(২) অনুচ্ছেদে কতিপয় মৌলিক অধিকারের অবাধ সুযোগ সংকুচিত করা হয়। কিন্তু উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানে এমন কোনো বিধান ছিল না যা মৌলিক অধিকার সমূহের মূল মর্ম সংকুচিত করে। সংবিধানের রচয়িতাগণ স্পষ্টত কোনো ধরনের নিবৃত্তিমূলক আটক আইন, নিরাপত্তা আইন বা জরুরি অবস্থাকালীন বিধানাবলির মতো রক্ষাকবচ ছাড়াই মৌলিক অধিকারসমূহকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। কঠোর কোনো রক্ষাকবচ এবং জরুরি অবস্থা জারি, যার ফলে মৌলিক অধিকারসমূহ স্থগিত হয়ে যায় এবং আদালতসমূহ মৌলিক অধিকার প্রয়োগের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, সেরকম কোনো বিধান না থাকায় দেশে সীমিত শাসন ও আইনের শাসনের ধারণা বেশ কার্যকর হতে পেরেছিল।
উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, জরুরি অবস্থা জারির পরিচিত বিধান, নিবৃত্তিমূলক আটক আইন বা নিরাপত্তা আইনের বিধান সংবিধানে অনুপস্থিত থাকায় বোঝা যায় যে, একটি মুক্ত ও গণতান্ত্রিক সমাজের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির ব্যাপারে সংবিধান প্রণেতারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের উদ্দীপনা স্বল্পস্থায়ী হয়, কারণ এ অবস্থা বেশিদিন বজায় ছিল না। দেড় বছরের মধ্যেই সংবিধানে জরুরি অবস্থা জারির বিধান সংযুক্ত হয়। অচিরেই নিরাপত্তা আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং আরও কয়েকটি বিধিনিষেধমূলক পদক্ষেপ গৃহীত হয়। সংবিধানে এসব পরিবর্তন ও সংযোজনের ফলে একটি মুক্ত সমাজের আদি আদর্শিক ধারণা নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। ১৯৭৪ সাল নাগাদ বাংলাদেশের সংবিধান একটি মুক্ত সমাজের জন্য উপযুক্ত দলিলের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধানের একটি অনুলিপিতে পরিণত হয়।
বিশেষ ক্ষমতা বিল ১৯৭৪-এ নিবৃত্তিমূলক আটকের বিধান ও কতিপয় গুরুতর অপরাধের শাস্তি কার্যকর করার লক্ষ্যে দ্রুত বিচারের বিধান করা হয়। ১ থেকে ১৪ ধারা পর্যন্ত বিনাবিচারে আটক, বিনা পরোয়ানায় সর্বোচ্চ ১২০ দিন আটক, এবং এ আইনবলে গঠিত উপদেষ্টা বোর্ডের সুপারিশক্রমে আটকাদেশের মেয়াদ আরও বৃদ্ধির বিধান দেয়া হয়। তবে বলা হয় যে, আটক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের ১৫ দিনের মধ্যে তার বিরুদ্ধে অভিযোগনামা পেশ করতে হবে। যদিও তাত্ত্বিকভাবে কোনো ব্যক্তিকে ১২০ দিনের বেশি সময় আটক রাখার বিধান ছিল না, তবু বাস্তবে সরকার সহজেই একই ব্যক্তিকে পুনরায় গ্রেফতার করতে এবং আরও ১২০ দিন আটক রাখতে পারত।