বসন্তের কবিতা
বসন্ত এসে গেছে বাংলা রিলিক্স গান
শেষ বসন্ত
আজিকার দিন না ফুরাতে
হবে মোর এ আশা পুরাতে--
শুধু এবারের মতো
বসন্তের ফুল যত
যাব মোরা দুজনে কুড়াতে।
তোমার কাননতলে ফাল্গুন আসিবে বারম্বার,
তাহারি একটি শুধু মাগি আমি দুয়ারে তোমার।
বেলা কবে গিয়াছে বৃথাই
এতকাল ভুলে ছিনু তাই।
হঠাৎ তোমার চোখে
দেখিয়াছি সন্ধ্যালোকে
আমার সময় আর নাই।
তাই আমি একে একে গনিতেছি কৃপণের সম
ব্যাকুল সংকোচভরে বসন্তশেষের দিন মম।
ভয় রাখিয়ো না তুমি মনে!
তোমার বিকচ ফুলবনে
দেরি করিব না মিছে,
ফিরে চাহিব না পিছে
দিনশেষে বিদায়ের ক্ষণে।
চাব না তোমার চোখে আঁখিজল পাব আশা করি
রাখিবারে চিরদিন স্মৃতিরে করুণারসে ভরি।
ফিরিয়া যেয়ো না, শোনো শোনো,
সূর্য অস্ত যায় নি এখনো।
সময় রয়েছে বাকি;
সময়েরে দিতে ফাঁকি
ভাবনা রেখো না মনে কোনো।
পাতার আড়াল হতে বিকালের আলোটুকু এসে
আরো কিছুখন ধরে ঝলুক তোমার কালো কেশে।
হাসিয়া মধুর উচ্চহাসে
অকারণ নির্মম উল্লাসে,
বনসরসীর তীরে
ভীরু কাঠবিড়ালিরে
সহসা চকিত কোরো ত্রাসে।
ভুলে-যাওয়া কথাগুলি কানে কানে করায়ে স্মরণ
দিব না মন্থর করি ওই তব চঞ্চল চরণ।
তার পরে যেয়ো তুমি চলে
ঝরা পাতা দ্রুতপদে দোলে,
নীড়ে-ফেরা পাখি যবে
অস্ফুট কাকলিরবে
দিনান্তেরে ক্ষুব্ধ করি তোলে।
বেণুবনচ্ছায়াঘন সন্ধ্যায় তোমার ছবি দূরে
মিলাইবে গোধূলির বাঁশরির সর্বশেষ সুরে।
রাত্রি যবে হবে অন্ধকার
বাতায়নে বসিয়ো তোমার।
সব ছেড়ে যাব, প্রিয়ে,
সমুখের পথ দিয়ে,
ফিরে দেখা হবে না তো আর।
ফেলে দিয়ো ভোরে-গাঁথা ম্লান মল্লিকার মালাখানি।
সেই হবে স্পর্শ তব, সেই হবে বিদায়ের বাণী।
আজি বসন্ত জাগ্রত ধারে রাবিন্দ্রনাথ ঠাকুর
বসন্ত বন্দনা
– নির্মলেন্দু গুণ--
হয়তো ফুটেনি ফুল রবীন্দ্র-সঙ্গীতে যতো আছে,
হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে
বনের কুসুমগুলি ঘিরে । আকাশে মেলিয়া আঁখি
তবুও ফুটেছে জবা,–দূরন্ত শিমুল গাছে গাছে,
তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্তপথিক ।
এলিয়ে পড়েছে হাওয়া, ত্বকে কী চঞ্চল শিহরণ,
মন যেন দুপুরের ঘূর্ণি-পাওয়া পাতা, ভালোবেসে
অনন্ত সঙ্গীত স্রোতে পাক খেয়ে মৃত্তিকার বুকে
নিমজ্জিত হতে চায় । হায় কী আনন্দ জাগানিয়া ।
এমন আগ্রাসী ঋতু থেকে যতোই ফেরাই চোখ,
যতোই এড়াতে চাই তাকে দেখি সে অনতিক্রম্য ।
বসন্ত কবির মতো রচে তার রম্য কাব্য খানি
নবীন পল্ববে, ফুলে ফুলে । বুঝি আমাকেও শেষে
গিলেছে এ খল-নারী আপাদমস্তক ভালোবেসে ।
আমি তাই লঘুচালে বন্দিলাম স্বরুপ তাহার,
সহজ অক্ষরবৃত্তে বাঙলার বসন্ত বাহার ।
ভুল প্রেমে কেটে গেছে তিরিশ বসন্ত
– তসলিমা নাসরিন
ভুল প্রেমে কেটে গেছে তিরিশ বসন্ত, তবু
এখনো কেমন যেন হৃদয় টাটায়-
প্রতারক পুরুষেরা এখনো আঙুল ছুঁলে
পাথর শরীর বয়ে ঝরনার জল ঝরে।
এখনো কেমন যেন কল কল শব্দ শুনি
নির্জন বৈশাখে, মাঘ-চৈত্রে-
ভুল প্রেমে কেটে গেছে তিরিশ বসন্ত, তবু
বিশ্বাসের রোদে পুড়ে নিজেকে অঙ্গার করি।
প্রতারক পুরুষেরা একবার ডাকলেই
ভুলে যাই পেছনের সজল ভৈরবী
ভুলে যাই মেঘলা আকাশ, না-ফুরানো দীর্ঘ রাত।
একবার ডাকলেই
সব ভুলে পা বাড়াই নতুন ভুলের দিকে
একবার ভালোবাসলেই
সব ভুলে কেঁদে উঠি অমল বালিকা।
ভুল প্রেমে তিরিশ বছর গেল
সহস্র বছর যাবে আরো,
তবু বোধ হবে না নির্বোধ বালিকার।
শাপমোচন উপন্যাস রাবিন্দ্রনাথ ঠাকুর
যে-বসন্ত একদিন করেছিল কত কোলাহল __রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-
লয়ে দলবল
আমার প্রাঙ্গণতলে কলহাস্য তুলে
দাড়িম্বে পলাশগুচ্ছে কাঞ্চনে পারুলে;
নবীন পল্লবে বনে বনে
বিহ্বল করিয়াছিল নীলাম্বর রক্তিম চুম্বনে;
সে আজ নিঃশব্দে আসে আমার নির্জনে;
অনিমেষে
নিস্তব্ধ বসিয়া থাকে নিভৃত ঘরের প্রান্তদেশে
চাহি সেই দিগন্তের পানে
শ্যামশ্রী মূর্ছিত হয়ে নীলিমায় মরিছে যেখানে।
ফুল ফুটুক না ফুটুক
------সুভাষ মুখোপাধ্যায়--------
ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।
শান-বাঁধানো ফুটপাথে
পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ
কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে
হাসছে।
ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।
আলোর চোখে কালো ঠুলি পরিয়ে
তারপর খুলে –
মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে
তারপর তুলে –
যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে
যেন না ফেরে।
গায়ে হলুদ দেওয়া বিকেলে
একটা দুটো পয়সা পেলে
যে হরবোলা ছেলেটা
কোকিল ডাকতে ডাকতে যেত
– তাকে ডেকে নিয়ে গেছে দিনগুলো।
লাল কালিতে ছাপা হলদে চিঠির মত
আকাশটাকে মাথায় নিয়ে
এ-গলির এক কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ে
রেলিঙে বুক চেপে ধ’রে
এই সব সাত-পাঁচ ভাবছিল –
ঠিক সেই সময়
চোখের মাথা খেয়ে গায়ে উড়ে এসে বসল
আ মরণ ! পোড়ারমুখ লক্ষ্মীছাড়া প্রজাপতি !
তারপর দাড়ম করে দরজা বন্ধ হবার শব্দ।
অন্ধকারে মুখ চাপা দিয়ে
দড়িপাকানো সেই গাছ
তখন ও হাসছে।
ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে
- সাইদুর রহমান
শীত জড়তার হলো তবে নির্গমন
ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে;
ঘুমন্ত প্রকৃতির হলো চোখ উম্মোচন
হলো কত উদ্দীপ্ত এই ফাগুনে।
ধরিত্রী সাজলো যেন ঐ পরীর মত
পুষ্প পল্লবে সে অবিকল রানী;
কৃষ্ণচূড়া পলাশ ফুলে লালে রঞ্জিত
শুনি কলরব কুহু কুহু ধ্বনি।
এ ফাগুনে প্রকৃতি পড়ে বাসন্তী শাড়ি
সাজে রূপবতী তরুণী চপলা;
হয়ে যায় অলিরা তাই উন্মাদ ভারী
ভালোবাসে যে প্রকৃতি রূপকলা।
শুনি না আজি কোকিলের ঐ মধু ডাক
সর্বত্র শুধু দেখি বিষাক্ত ধোঁয়া;
আগের মত নেই সুগন্ধী পুষ্প ঝাঁক
নেই কোথাও সে সবুজের ছোঁয়া।
তবু আসে ফাগুন সে ঐ ঋতুর রাজা
ভালো যে বাসে সুন্দর বসুন্ধরা;
নিজের হাতে সাজিয়ে লুফে নেয় মজা
অবাক নয়নে দেখি সে অপ্সরা।
আয় রে বসন্ত
----রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-----
আয় রে বসন্ত, হেথা
কুসুমের সুষমা জাগা রে
শান্তিস্নিগ্ধ মুকুলের
হদয়ের গোপন আগারে।
ফলেরে আনিবে ডেকে
সেই লিপি যাস রেখে,
সুবর্ণের তুলিখানি
পর্ণে পর্ণে যতনে লাগা রে।
(স্ফুলিঙ্গ কাব্যগ্রন্থতে সংকলিত )
---বসন্তে –
-কুসুমকুমারী দাশ-
আকাশ ধরণী-তলে
কুঞ্জে কুঞ্জে বিহগ কণ্ঠে
লতায় পাতায় ফুলে |
হৃদয়ে সবার দিয়েছে রে দোল
নাচিয়া উঠিছে প্রাণ,
(এ যে) নূতন দেশের মোহন ঝঙ্কার
নূতন দেশের গান |
এ বসন্ত কার, দিতেছে বাহার
চেতনার ঢেউ খুলি
কেবা আপনার, কেবা পর আর
ব্যবধান গেছে খুলি
আজ সে এসেছে দেবদূত হয়ে
জাগাতে সহস্র প্রাণ,
কে আসিবি আয়, ওই শোনা যায়
আনন্দময়ের গান |
কে বাঁচিবি আয়, বাতাসে বাতাসে
পরশে চেতনা জাগে ;
কে বাঁচিবি আয়, হৃদয়ে হৃদয়ে,
আজি নব অনুরাগে |
বসন্তের অপেক্ষা
বসন্তের করাঘাত রিক্ত হিয়ার দ্বারে
কোকিলের সুর উদাসী করেছে মোরে,
সুরের ঐকতান কোথা হারালো
এমনি করে কতো বসন্ত পেরোলো।
অষ্টাদশী হৃদয়ে প্রনয়ের মনোভাব
বৃক্ষ শাখে পক্ষীর কলোরব,
মহুয়া মালতী রুদ্রপলাশ
তবো উপেক্ষায় হলেম হতাশ।
তবুও প্রতিক্ষার প্রহর হয় না শেষ-
বসন্তের সজ্জায় মিশে প্রনয়ের রেশ;
ভ্রমরা চেনাবে সখা পথ,
কুসুমিত কোমল পুষ্প রথ।
হৃদয় আঙ্গিনায় প্রজ্জ্বলিত আশার প্রদীপ,
বসন্ত তবো হিয়ায় জাগবে অন্তরীপ!
কন্টক নয় ফুলেল বান যে চাই
আপনাকে ভুলি আপনারই তরুছায়ায়।
ফাগুন হাওয়ায় হিল্লোল উঠে শাখে
সে নেত্রে কি মোর প্রতিচ্ছবি রাখে?
দেবদারু ফুল উড়ায় শঙ্খচিলে
প্রেমের পসরা লুটায় হেলায় পড়ে।
জাফরানের উপকারিতা সম্পর্কে জানুন
বসন্তরূপ
বসন্ত এলো যে ধরায়
উদাসি কোকিলের সুর মন ভরায়,
কৃষ্ণচূড়ায় রাজপথ সাজে
সঙ্গীতের কলতান কানে বাজে।
মদন দেবের আশীর্বাদ
আবির রাঙ্গা চারিপাশ,
বউ কথা কও পাখি ডাকে
ছেলে বুড়ে সব আনন্দে মাতে।
ভ্রমরায় দল বেধে চলে
ফুল ফোটে কাননে কাননে,
বৃক্ষে নতুন পত্র-পল্লব জাগে
সবকিছু অপরূপ লাগে।
শীতের আমেজ মুছে যায়
প্রকৃতির রঙ্গিন সজ্জায়,
এতসব নতুনের ভিড়ে
রুক্ষতা কাটে ধীরে ধীরে।
সকল অঞ্জলি এখনও শুধু যে তার
বসন্তকে করিতে বরন-
পথে-প্রান্তরে চলে মহারন।
জরাজীর্ণ শীতের পর বসন্তের আগমনে প্রকৃতি সেজেছে নতুন রুপে। বাঙালি প্রাণ যখন বসন্ত বরণ করছে ঠিক তখন সম্ভাবনার এক নতুন বাংলাদেশ দেখার অপেক্ষায় বিশ্ব বাঙালি। এ স্বপ্নকে চেতনায় ধারণ করেই প্রকৃতিতে লেগেছে বসন্তের ছোঁয়া। তাইতো বসন্ত অনন্ত সম্ভাবনার ঋতু।
বসন্তকে নিয়ে বাঙালির কৌতূহলের শেষ নেই। বসন্তকে নিয়ে আবেগ তাড়িত বাঙালি- কবি- সাহিত্যিকরা লিখেছেন অনন্য অসাধারণ সব গান-কবিতা। বসন্তের গানে মাতোয়ারা বাঙালির কণ্ঠে উঠে বসন্ত বন্দনা-
‘বাতাসে বহিছে প্রেম নয়নে লাগিল নেশা/ কারা যে ডাকিল পিছু বসন্ত এসে গেছে/ মধুর অমৃত গানে জানা গেল সহজে / মরমে এসেছে বাণী বসন্ত এসে গেছে.....!
বসন্ত বন্দনায় মন আনমনে গেয়ে উঠে - ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/ তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান...আমার আপনহারা প্রাণ/ আমার বাঁধন ছেঁড়া প্রাণ....../ তোমার অশোকে কিং সুখে, অলক্ষে রঙ লাগলো আমার অকারণের সুখে..../ পূর্ণিমা সন্ধ্যায় তোমার রজনী গন্ধায়/ রুপ সাগরের পাড়ের পানি উদাসী মন দায়।’
এছাড়া- ‘রঙ লাগালে বনে বনে, ঢেউ জাগালে সমীরণে, আজ ভুবনের দুয়ার খোলা, দোল দিয়েছে বনের দোলা’- প্রকৃতি আজ খুলে দেবে দখিন দুয়ার। বইবে ফাগুনের মৃদুমন্দ দখিনা হাওয়া।’
নতুন করে জেগে উঠা, নতুন আনন্দে-আশায় রঙিন হয়ে ওঠার আবাহনে সে হাওয়া গাইবে- ‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল/ স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল, দ্বার খোল দ্বার খোল।’
বসন্তের প্রথম সকালে বাংলার চপলা নারীরা যেদিন বাসন্তী রং শাড়ি পড়ে, কপালে টিপ, হাতে কাঁচের চুড়ি, পায়ে নূপুর, খোঁপায় ফুল জড়িয়ে বেড়িয়ে পড়বে সেদিন চির যৌবনা বসন্ত প্রকৃতিতে স্পস্ট হয়ে উঠে। বসন্ত পোশাক পাঞ্জাবি, ফতুয়া পরা ছেলেরাও সঙ্গী হবে বসন্তবরণের বিভিন্ন আয়োজনে। দখিনা হাওয়া, মৌমাছির গুঞ্জরণ, কচি-কিশলয় আর কোকিলের কুহুতানে জেগে ওঠার দিন আজ।
এসএ/